জ্যামিতিক বিশ্লেষণের পদ্ধতি
জ্যামিতিতে কতগুলি সরল ধারণা ব্যবহার করে যুক্তিভিত্তিক জটিলতর কাঠামো গঠন করা হয়। এই সরল ধারণাগুলিকে মোটামুটি তিনটি বড় শ্রেণীতে ভাগ করা সম্ভব - অসংজ্ঞায়িত পদসমূহ, সংজ্ঞায়িত পদসমূহ এবং স্বতঃসিদ্ধসমূহ। অসংজ্ঞায়িত পদসমূহ জ্যামিতির কিছু কেন্দ্রীয় ধারণার কোন সরল সংজ্ঞা নেই। এই অসংজ্ঞায়িত ধারণাগুলির মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হল বিন্দু, রেখা ও তলের ধারণা। এই মৌলিক ধারণাগুলি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত। একটি বস্তু কোথায়? - এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট, স্থির অবস্থানের কথা চিন্তা করতে হয়। "বিন্দু" পদটি দিয়ে আমাদের এই স্বজ্ঞাভিত্তিক (intuitive) স্থির, নির্দিষ্ট অবস্থানের ধারণাকেই নির্দেশ করা হয়। অনেক ভৌত বস্তুই বিন্দুর ধারণা নির্দশ করে। যেমন কোন ব্লক আকৃতির বস্তুর কোনা, পেন্সিলের ডগা, কিংবা কাগজের উপর ফুটকি। এই জিনিসগুলিকে বিন্দু নামক মানসিক, বিমূর্ত ধারণাটির বাস্তব, মূর্ত প্রতিরূপ বা মডেল হিসেবে গণ্য করা হয়। একইভাবে একটি টানটান সুতা, টেবিলের ধার, পতাকাবাহী দণ্ড, ইত্যাদি পরপর সাজানো অনেকগুলি বিন্দুকে নির্দেশ করে। যদি কল্পনা করা যায় যে এই বিন্দুসারি দুই দিকে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত, তবে আমরা যে মানসিক ধারণাতে উপনীত হই, জ্যামিতিতে তার নাম দেয়া হয়েছে "রেখা"। আর "তল" পদটি কোন চ্যাপ্টা পৃষ্ঠ যেমন মেঝে, টেবিলের উপরটা, কিংবা ব্ল্যাকবোর্ড ইত্যাদি ভৌত বস্তু দিয়ে নির্দেশ করা যায়, কিন্তু আমাদেরকে কল্পনা করে নিতে হবে যে এটি চারিদিকে অসীম পর্যন্ত সম্প্রসারিত, অর্থাৎ রেখার যেমন কোন শেষবিন্দু নেই, ঠিক তেমনি তলের কোন ধার নেই। জ্যামিতির অন্যান্য অসংজ্ঞায়িত পদগুলি বিন্দু, রেখা ও তলের মধ্যে সম্পর্কের বর্ণনা দেয়। যেমন - "একটি রেখার উপর অবস্থিত একটি বিন্দু" বাক্যাংশটি একটি অসংজ্ঞায়িত সম্পর্ক। অর্থাৎ এটিকে আরও কোন সরলতর ধারণার সাহায্য নিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। সংজ্ঞায়িত পদসমূহ অসংজ্ঞায়িত পদগুলিকে একত্র করে অন্যান্য পদের সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব, যেগুলিকে বলা হয় সংজ্ঞায়িত পদ। যেমন অসমরেখ বিন্দু বলতে সেইসব বিন্দুকে বোঝায় যারা একই রেখার উপর অবস্থিত নয়। একটি রেখাংশ বলতে বোঝায় কোন দুইটি নির্দিষ্ট বিন্দু ও এদের মধ্যবর্তী সমস্ত বিন্দু নিয়ে গঠিত কোন রেখার অংশ। আবার রশ্মি বলতে বোঝায় একটি আংশিক রেখাকে বোঝায় যার একটিমাত্র শেষবিন্দু আছে এবং বাকি সমস্ত বিন্দু ঐ শেষবিন্দু থেকে কোন এক দিকে অসীম পর্যন্ত প্রসারিত। সংজ্ঞায়িত পদগুলিকে একে অপরের সাথে এবং অসংজ্ঞায়িত পদের সাথে একত্র করে আরও অনেক পদের সংজ্ঞা দেয়া যায়। যেমন - কোণ বলতে দুইটি রশ্মিকে বোঝায় যাদের একটি সাধারণ শেষবিন্দু আছে। একইভাবে ত্রিভুজ ধারণাটিকে তিনটি অসমরেখ বিন্দু এবং এদের মধ্যে অবস্থানকারী রেখাংশের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
স্বতঃসিদ্ধসমূহ :
স্বীকার্য বা স্বতঃসিদ্ধগুলি হচ্ছে অপ্রমাণিত কিন্তু সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত কিছু অনুমান, যেমন - "দুইটি ভিন্ন বিন্দুর মধ্য দিয়ে একটি এবং কেবলমাত্র একটি রেখা গমন করতে পারে"। যে ব্যবস্থা বা সংশ্রয়ে বিন্দু, রেখা ও তল সম্পর্কিত কতগুলি বিরোধিতাহীন স্বতঃসিদ্ধ প্রস্তাব করা হয় এবং এই স্বতঃসিদ্ধগুলি থেকে বিভিন্ন উপপাদ্য প্রমাণ করা হয়, সেই সংশ্রয়কে একটি জ্যামিতিক ব্যবস্থা (বা সংক্ষেপে জ্যামিতি) বলা হয়। স্বতঃসিদ্ধসমূহের বিভিন্ন সেট ব্যবহার সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন জ্যামিতিক ব্যবস্থায় উপনীত হওয়া সম্ভব। যদি ভৌত স্থান বা জগতের অভিজ্ঞতার সাথে স্বতঃসিদ্ধগুলির মিল থাকে, তবে যৌক্তিকভাবে আশা করা যায় যে ঐ স্বতঃসিদ্ধগুলি ব্যবহার করে প্রাপ্ত সিদ্ধান্তগুলিও ভৌত জগতের অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যাবে। তবে যেহেতু যেকোন স্বতঃসিদ্ধের সেটই খণ্ডিত, অসম্পূর্ণ অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে পছন্দ করা হয়, সুতরাং তাদের সিদ্ধান্তগুলিও বাস্তব জগতের সাথে পুরোপুরি মিলে যাবে না। তাই কিছু কিছু জ্যামিতিক ব্যবস্থা বাস্তব জগতে সম্পূর্ণ প্রয়োগ না-ও করা যেতে পারে।
উপপাদ্যসমূহ :
উপপাদ্যগুলি স্বতঃসিদ্ধগুলি থেকে যুক্তিভিত্তিক আরোহী পদ্ধতিতে বের করা হয়। আর এই আরোহী পদ্ধতিকে বলা হয় উপপাদ্যটির প্রমাণ। কোন প্রমাণের প্রতিটি ধাপকে হয় কোন স্বতঃসিদ্ধ অথবা কোন পূর্ব-প্রমাণিত উপপাদ্য দিয়ে সমর্থিত হতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি উপপাদ্য বলে যে, যদি একটি রেখা কোন সমান্তরাল রেখাজোড়ের যেকোন একটির সাথে সমান্তরাল হয়, তবে সেটি রেখাজোড়ের অপর রেখাটির সাথেও সমান্তরাল। এখানে সমান্তরাল রেখা বলতে সেই সব রেখাকে বোঝায় যারা একে অপরের থেকে তাদের গোটা দৈর্ঘ্য বরাবর সমান দূরত্ব্ব বজায় রাখে। আমরা যখন জ্যামিতিতে কোন উপপাদ্য প্রমাণ করি, তখন আমরা কতগুলি অনুমানের একটি সেট থেকে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হই।
Post a Comment