মিশরের শহীদ প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মাদ মুরসি
ড. মুহাম্মাদ মুরসি জন্ম পরিচয়:
প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম একটি হলো মিশর। যে মিশরে জন্ম গ্রহন করেছিল অসংখ্য নবি-রাসূলগণ সে মিশরে ১৯৫১ সালের ৮ ই আগস্ট আল শারকিয়্যাহর আল আদওয়াহ গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহন করেছিল মিশরের ইতিহাসে এক অবিসংবাদী নেতা। নাম ড. মুহাম্মাদ মুরসি। তিনি ছিলেন মিশরের ৫ হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি।
•ড. মুহাম্মাদ মুরসি কর্মজীবন
ড. মুহাম্মাদ মুরসির কর্মজীবন শুরু হয় কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। এক সময় তিনি যোগদান করেন সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর তিনি আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৮৫ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মিশরের শারকিয়ার জাকাজিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপকও ছিলেন। তিনি নাসা (NASA)’তে ‘স্পেশ শ্যাটল ইঞ্জিন’ উন্নয়নেও কাজ করেছেন।
• ড. মুহাম্মাদ মুরসি রাজনৈতিক জীবন
১৯২৮ সালে ইমাম হাসান আল বান্নার হাতে ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’ নামে একটি আন্দোলনের সূচনা হয়। মুরসি ১৯৭৭ সাল থেকে ইখওয়ানুল মুসলিমিনে সক্রিয় থাকলেও সদস্যপদ গ্রহন করেন ১৯৯২ সালে। ১৯৯৫ ও ২০০০ সালের নির্বাচনে তিনি ইখওয়ানের হয়ে প্রার্থীতা করে জয়লাভ করেন। কিন্তু ২০০৫ সালের নির্বাচনে মুরসি জয়লাভ করলেও, তার বিরোধীকে বিজয়ী দেখানো হয়। ২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউয়ে মিশর যখন লণ্ডভণ্ড তখন তিনি সর্বদলীয় মোর্চা ‘ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস’ দল গঠন করেন এবং দলকে বিজয় এনে দেন।
• শিক্ষাজীবন:
এলাকার স্কুল থেকে তিনি প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। ১৯৭৫ সালে কাইরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতকে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে এবং ১৯৭৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। পরবর্তীতে PhD’র জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ১৯৮২ সালে সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
অতঃপর, ২০১২ সালের নির্বাচনে ইখওয়ানের পক্ষ থেকে খায়রাত আশাশাতেরকে প্রার্থী হিসবে ঘোষণা করা হয় এবং মুরসিকে স্যান্ডবাই প্রার্থী রাখা হয়। নির্বাচনের ঠিক আগের মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন খায়রাত আশাশাতেরকে প্রার্থী হিসবে ডিসকোয়ালিফাই ঘোষণা করে। ফলে ইখওয়ানের পক্ষ প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়েন মুরসি। এ নির্বাচনে মুরসির প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সেনা সমর্থিত আহমাদ শফিক। দুজনের মধ্যে বেশ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় এবং দুজনই ৫০% ভোট পেতে ব্যর্থ হলে ২য় দফায় আবার নির্বাচন হয়। শেষ পর্যন্ত ৫২% ভোট পেয়ে এ লড়াইয়ে শেষ হাসি হাসে মুরসি। কিন্তু মুরসিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে না ঘোষণা করতে শুরু হয় বিভিন্ন ষড়যন্ত্র। শেষ পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নির্বাচন কমিশন মুরসিকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করতে বাধ্যহয়। কিন্তু, বিধিবাম! দায়িত্ব গ্রহনের অল্পদিনের মধ্যে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
• রাষ্ট্রপতি হিসেবে অনাড়ম্বর জীবন যাপন
রাষ্ট্রপতি হয়েও মুরসি জীবনযাপন করেছেন একজন সাধারণ মিশরীয় নাগরিকের মতোই। মিশরের রাষ্ট্রপতিদের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ, বিলাশবহুল বড় বড় ভবন বরাদ্দ থাকলেও মুরসি থাকতেন ভাড়া করা বাসায়। এক লেখক মন্তব্য করেছেন যে, ‘এখনকার সময়ে আমরা অনেক মুসলিম শাসকই পাবো, যাদের টয়লেটের আকার মুরসির পুরো বাসায় চেয়ে বড়।’ যখন তিনি ভাড়া বাসা ছেড়ে প্রেসিডেন্ট হাউযে উঠেন তখন বলেছিলেন, “আমি ভাড়া বাসা থেকে সরকারি ভবনে এসেছি, আমার পকেটে কোনো পয়সা নেই। আমি যখন চলে যাব, তখন তোমরা আমাকে পরীক্ষা করবে, এর চেয়ে বেশি কিছু আমার কাছে পাও কিনা। যদি পাও তবে বুঝবে, আমি খিয়ানত করেছি।”
একবার মুরসির আপন বোন গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যুশয্যায় পতিত হন। চিকিৎসকরা তার বোনের চিকিৎসার জন্য ইউরোপ বা আমেরিকার ভালো কোন হাসপাতলে পাঠাতে বলে। কিন্তু মুরসি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তার যুক্তি ছিল প্রেসিডেন্ট পদের সুযোগ নিয়ে পরিবারের কাউকে সাধারণ মিশরীয় নাগরিকের চেয়ে বেশি সুবিধা দিতে পারি না।
প্রেসিডেন্ট মুরসি যখন রাস্তায় বের হতো তখন আলাদা নিরাপত্তার জন্য রাস্তা বন্ধ করতো না। বরং তিনি গাড়ির ছাদ খুলে দাঁড়িয়ে রাস্তার পাশে মানুষদের সালাম ও অভিবাদন জানিয়েছেন।
মিশরে ভবনে ভবনে রাষ্ট্রপতির ছবি টাঙ্গিয়ে রাখার প্রথা ছিল। কিন্তু মুরসি প্রেসিডেন্ট হবার পর তা নিষিদ্ধ করেন। মুরসি ছিল বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে কম বেতনের রাষ্ট্রপতি। তিনি বছরে ১০ হাজার ডলার বেতন পেতেন।
বর্তমান যুগে মুরসির মতো অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে এমন রাষ্ট্রপতি খুঁজে পাওয়া রীতিমতো দুষ্কর!
• প্রেসিডেন্ট মুরসির ইসলামি বিধিবিধানের প্রতি কঠোর আনুগত্য
প্রেসিডেন্ট মুরসি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামি বিধিবিধান পালনে ছিলেন সোচ্চার। নিজে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতেন, সাওম রাখতেন, যাকাত দিতেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হবার আগে ও পরে খুব কম সময়ই ফজরে, এশা, তারাবির সালাতে জামাতে অনুপস্থিত থেকেছেন। প্রতিদিন ফজরের আজানের বেশ কিছু সময় আগে প্রেসিডেন্ট মুরসি এবং য়ার স্ত্রী নাজলা আলী মাহমুদ মসজিদে চলে যেতেন এবং মসজিদের বাথরুম এবং অযুখানা পরিষ্কার করে দিতেন। তারপর তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে, ফজর পড়ে বাসায় ফিরতেন। জুমার দিনে মসজিদে খুতবা দিতেন, তারাবির নামাযে নাসিহা পেশ করতেন।
প্রেসিডেন্ট মুরসির জামাতে সালাতে আদায় নিয়ে কিছু মিডিয়া বেশ হৈচৈ শুরু করে দেয়। জামাতে সালাদ আদায় করতে গিয়ে নাকি বাড়তি ফোর্সের দরকার পড়ছে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হচ্ছে! এইসব মিডিয়ার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট মুরসি বলেনে, “আমি মসজিদে গিয়েই সাধারণ মানুষদের সাথে জামাতে সালাদ আদায় করবো। আমার কোন নিরাপত্তার দরকার নেই। একান্ত ফোর্স লাগলে তার ব্যয়ভার আমি নিজে বহন করব। তবু মসজিদ ছাড়তে পারবো না।” প্রেসিডেন্ট মুরসি ছিল এক আল্লাহর উপর আস্থাশীল ফলে ৬ বছর জেলে থেকেছেন কিন্তু তিনি কোন জালিমের প্রস্তাব মেনে নেননি।
রাষ্ট্রীয় জীবনেও মুরসি ছিলেন ইসলামের প্রতি কঠোর আনুগত্যশীল। তিনি কখনো রাষ্ট্রীয় আমানতের খেয়ানত করেননি যা তার এই কথা থেকেই স্পষ্ট – [ আমি ভাড়া বাসা থেকে সরকারি ভবনে এসেছি, আমার পকেটে কোনো পয়সা নেই। আমি যখন চলে যাব, তখন তোমরা আমাকে পরীক্ষা করবে, এর চেয়ে বেশি কিছু আমার কাছে পাও কিনা। যদি পাও তবে বুঝবে, আমি খিয়ানত করেছি।”]।
তিনি ভবনে ভবনে প্রেসিডেন্ট মুরসির নাম লিখতে বারণ করেন এবং সরকারি অফিসগুলোতে আল্লাহ তা’আলার নামের সুন্দর সুন্দর ক্যালিওগ্রাফি লাগানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। তিনি এ নির্দেশও দিয়েছিলেন যে তার নামের পরিবর্তে সূরা বাকার ২৮১ নম্বর আয়াতটি লিখতে। সূরা বাকার ২৮১ নম্বর আয়াতটি হলো, “ওই দিনকে ভয় করো, যে দিন তোমরা আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে। অতঃপর প্রত্যেককেই তার কর্মের ফল পুরোপুরি পাবে এবং তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না।”
• রাষ্ট্রপতি হিসেবে যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্তসূমহ
প্রেসিডেন্ট মুরসি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহন করেন ২০১২ সালের ৩০ জুন এবং ক্ষমতাচ্যুত হন ২০১৩ সালের ৩ জুলাই। অর্থাৎ তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১ বছর ৪ দিন বা ৩৬৯ দিন। এতো অল্প সময়ে তিনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং দুঃসাহসিক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যার বাস্তবায়ন হলে আজকে মিশরে চিত্র ভিন্নরূপ হতে পারতো, ভিন্নরূপ হতে পারতো ফিলিস্তিনে ভাগ্যরেখাও। এই সুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যই হয়তো টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘The most important man in the middle east’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সিদ্ধান্তসূমহ হলো:
➤ ২০১২ সালের নভেম্বরে ইসরাইল কর্তৃক গাজায় জোরপূর্বক অভিবাসন চালালে ফিলিস্তিনের সাথে যুদ্ধে বেধে যায়। মুরসি ফিলিস্তিনের পক্ষে হুংকার ছেড়ে বলেছিলে, “মনে রেখো ফিলিস্তিনরা একা নয়।” তিনি এর প্রতিবাদস্বরূপ তাৎক্ষণিকভাবে ইসরাইলের রাজধানী তেল’আবিব থেকে মিশরীয় দূতাবাস প্রত্যাহার করে নেন।
➤ সুয়েজ খাল উন্নয়নের বিরাট অঙ্কের বাজেট নির্ধারন করেন। যার সঠিক বাস্তবায়ন হলে শুধু সুয়েজ খাল থেকেই মিশরে আয় হতো ১০০ বিলিয়ন ডলার। আমেরিকার বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি বলেন, “মুরসির সুয়েজ খালের ডেভেলমেন্ট প্লান বাস্তবায়ন হলে আমিরাতের অর্থনীতিতে ব্যাপক ধস নেমে আসবে। কারণ, দুবাই ও আবুধাবির সাপোর্টগুলো তখন মূল্য হারিয়ে ফেলবে। ফলে আমেরিকার অর্থনীতিতে দুবাই থেকে আসা সুবিধা লুপ্ত হবে।”
➤ মিশরের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে যাতে অন্যান্য দেশ সাহায্য সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয় এ জন্য তিনি চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, পাকিস্তান, সাউথ আফ্রিকা, সৌদি আরব এবং আরব আমিরাতে রাষ্ট্রীয় সফর করেন।
➤ ক্ষমতায় যাবা সাথে সাথে সিনাইতে মিশরে যে ৩১% ভূমি আছে সেখানটা আধুনক সুযোগসুবিধা সম্পন্ন বসতবাড়ি, ব্যবসায়ীক প্রতিষ্টি ও দুটো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সাহসী উদ্যোগ নেন। এ পরিকল্পনার পুরোটা বাস্তবায়ন হলে মিশরে ইনকাম ডাবল হয়ে যেত, সুরাহা হতো বেকার সমস্যাও।
Post a Comment