উপমহাদেশীয় প্রত্নতত্ত্ব, হরপ্পা সভ্যতা ও আর্যতত্ত্ব

  • কৃষ্ণেন্দু দাস

শুধু আমাদের গ্রুপে নয়, যে কোনো ইতিহাস বিষয়ক গ্রুপেই যে বিষয়টি নিয়ে সবথেকে বেশী আলোচনা হয়েছে, সেটা আর্য সমস্যা ও হরপ্পা সভ্যতা। এবং প্রায়শই সেটা অত্যন্ত খারাপ ধরণের ব্যক্তিগত ঝগড়ার রূপ নিয়ে তুই তোকারি থেকে বাপান্ত করে শেষমেশ সাক্ষাতে দেখে নেওয়া পর্যন্ত গড়ায় এবং সবশেষে গ্রুপ ও অ্যাডমিনদের তেড়ে গালাগাল করে তা শেষ হয়। গ্রুপের নিয়মকানুন ও শালীনতা বজায় রাখতে আমাদের অনেকসময়েই সেই সমস্ত "ভদ্রমহোদয়"কে গ্রুপ থেকে বিতারণ করতে হয়। যাই হোক যেটা বলতে আজ এই লেখার অবতারণা সেটা হল হরপ্পা সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ব ও আর্য সমস্যা।


এক্ষেত্রে তিন ধরণের মানুষ আলোচনায় অংশ নেন। এক পক্ষ যাঁরা আর্য আগমন তত্ত্বে বিশ্বাসী। আর এক পক্ষ আর্য আগমন তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। এছাড়াও আর এক পক্ষ আছেন, যাঁরা এই বিষয়টা জানতে চান।
প্রথম পক্ষ, অর্থাৎ যাঁরা এই তত্ত্বে বিশ্বাসী তাঁরা প্রায়শই এর প্রত্নতাত্ত্বিক দুর্বলতাগুলো এড়িয়ে যান অথবা কিছু বাতিল ও বস্তাপচা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের কথা বলেন এবং অক্ষমের আস্ফালনের মত সরাসরি অপরপক্ষকে এবং গ্রুপটিকে "আর এস এস" বলে দাগিয়ে দিয়ে পরিতোষ লাভ করেন।
দ্বিতীয় পক্ষ, যাঁরা আর্য আগমন তত্ত্বে অবিশ্বাসী তাঁরা বেশিরভাগ সময়েই এমন সব প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য প্রমাণের উল্লেখ করেন এবং উক্তি ও যুক্তি পেশ করেন যার কোনো সঠিক উৎস নির্দেশ থাকে না এবং যা যথাযথও নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাতে নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠার চেয়ে অন্যপক্ষকে আক্রমণই প্রধান হয়ে ওঠে।
এই সংক্রান্ত বিভিন্ন 'Academic' বাদানুবাদ থেকে প্রথমপক্ষের কিছু যুক্তি ও ভারতীয় উপমহাদেশে হরপ্পা সভ্যতা পরবর্তী আর্য অভিবাসনের যে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলি দাখিল করা হয় তার মধ্যে রয়েছে গান্ধার সমাধি সংস্কৃতি বা Gandhara Grave Culture, সিমেটারি এইচ সংস্কৃতি, চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি বা Painted Grey Ware Culture বা PGW সংস্কৃতি, ঝুকার সংস্কৃতি, তাম্রভান্ডার সংস্কৃতি বা Copper Hoard Culture ইত্যাদি। এর সঙ্গে থাকে ১৮০০ খ্রিষ্টপূর্বের আগে ভারতীয় উপমহাদেশে ঘোড়া, অরযুক্ত চাকা, রথ, মৃতদেহের অগ্নি সৎকার ইত্যাদির না পাওয়া যাবার যুক্তি। আরো কিছু তর্ক থাকে যেমন, বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ আর্য আগমন তত্ত্ব সমর্থন করেন, যাঁরা করেন না তাঁরা মূলত হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসবিদ বা প্রত্নবিদ ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে এঁদের কাছে রেফারেন্স চাওয়া হলে দেখা যায় যে সেটা মূলত কিছু খুব পরিচিত হাতে গোনা বই বা প্রবন্ধের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। মূলত শর্মা, হাবিব, থাপার বা চক্রবর্তী (রণবীর)। সবচেয়ে আশ্চর্য হই যখন দেখি হারারির ' সেপিয়েন্স ' পর্যন্ত অনেকের কাছে আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে!! এছাড়া আছে ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়ানো বিপুল তথ্যরাশি। এতদূর পর্যন্ত পড়ে টড়ে তাঁদের মনে হরপ্পা সভ্যতা বা তার পরবর্তীকালের আর্য অভিবাসন ইত্যাদি সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরী হয়। তাঁরা বুঝতে শেখেন যে, ভারতীয় উপমহাদেশে ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বের আগেকার কোনো প্রত্ন অবশেষের সাথে কোনো বৈদিক রীতির সাযুজ্য দেখালে সেটা হল জোর করে ইতিহাসের সঙ্গে "ধর্মের" মিশ্রণ ঘটানোর অপচেষ্টা কিন্তু সেটা যদি ২০০০ বা ১৮০০ খ্রিষ্টপূর্বের পরবর্তী কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক কাঠামো হয় তাহলে তা ইতিহাসের সত্য! কিন্তু যাঁরা এখনও নিজেরা চিন্তা ভাবনা করার শেষ শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেননি, তাঁরা ভেবে দেখুন তো আপনাকে যা শেখানো হলো (অন্তত প্রত্নতাত্ত্বিক সত্য বলে যা চালানো হলো) তার ভিত্তি যথেষ্ট দৃঢ় তো? শর্মা, হাবিব, থাপাররা যে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলি দাখিল করলেন তাতে সবটা বলা হয়েছে তো? ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু চেপে যাওয়া অথবা একেবারে সরাসরি ভুল, অর্ধসত্য বা মিথ্যে তথ্য দিয়ে পাঠককে ভুল পথে চালানোর চেষ্টা করা হয়নি এব্যাপারে আপনি নিশ্চিত তো? এই পর্যন্ত এসে আপনার যদি মনে হয় যে আমি অবশ্যই ইতিহাসের একটি "হিন্দুত্ববাদী" ও বিকৃত ব্যাখ্যা দিতে এসেছি তাহলে আপনার জন্য একটি ছোট্ট কাজ দিচ্ছি।
আপনি উপরোক্ত ঐতিহাসিকবৃন্দের যে কোনো লেখা থেকে হরপ্পা সভ্যতা বা আর্যতত্ত্ব সম্বন্ধীয় মাত্র দুটি সরাসরি মিথ্যাভাষণ বা ইচ্ছাকৃত ইতিহাসের তথ্যগোপনের উদাহরণ দিন (ভুরি ভুরি উদাহরণের মধ্যে মাত্র দুটো চেয়েছি। অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। না পারলে আমি দিয়ে দেবো পৃথক পোস্ট করে।)। এক্ষেত্রে আপনি তিন ধরণের মনোভাব পোষণ করতে পারেন।
১) বিষয়টি আপনি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে পারেন। কারণ আপনি বুঝে গেছেন যে এটি কেবলমাত্র একটি নিখাদ ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি জানেন যে উপরোক্ত ইতিহাসবেত্তারা যা লেখেন সেটাই প্রকৃত ইতিহাস বাকিটা আস্তাকুঁড় মাত্র। সেক্ষেত্রে বোঝা যাবে যে আপনার দায়বদ্ধতা ইতিহাসের প্রতি নয়, বরং বিশেষ একশ্রেণীর ইতিহাসবিদদের প্রতি। আপনি তাঁদের অন্ধ অনুসারী মাত্র।
২) আপনি জানেন যে এঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাস বিকৃত করেন। কিন্তু আপনিও এঁদের অন্ধভক্ত ও সুবিধেবাদী হওয়ার দরুণ আপনি এঁদের হয়েই গলা ফাটান আর কেউ কিছু বলতে এলেই ওনাদের অক্সফোর্ড, হার্ভার্ডের ছাপ দেখিয়ে বুক বাজিয়ে নিজের জয় ঘোষণা করেন।
৩) আপনি ইতিহাসে আগ্রহী অবশ্যই তবে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সম্বন্ধে আপনার খুব একটা ধারণা নেই। তাই ওই বিশেষ গোষ্ঠীর "রচিত" ইতিহাসে আপনি বিশ্বাস করেন মাত্র। আপনি সঠিকভাবে না জেনেই তর্কে নেমেছেন।
আসলে আমাদের বোকা বানানোটা যে খুব সোজা সেটা ওই "EMINENT" গোষ্ঠী খুব ভালোভাবেই বোঝেন। কারণ তাঁরা জানেন যে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে আমাদের ধারণা এতটাই সীমিত যে ওনাদের শিখিয়ে দেওয়া তত্ত্ব মাথায় করেই আমাদের ইতিহাস জ্ঞান সার্থক হয়ে যাবে। তাকে প্রশ্ন করা তো দূর সে কথা চিন্তা করাও ঘোর পাপের সামিল! একেবারে অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড বলে কথা! তাদের আবার প্রশ্ন করা যায় নাকি? তাঁরা তাঁদের বিভিন্ন লেখায় আমাদের বলেছেন যে হরপ্পা সভ্যতার অবসানের পর আর্য নামের একদল যাযাবর গোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশে আসলো, যাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গান্ধার সমাধি সংস্কৃতি, সিমেটারি এইচ সংস্কৃতি, চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি, ঝুকার সংস্কৃতি আর কিছুটা কালো - লাল মৃৎপাত্র সংস্কৃতি ইত্যাদির মধ্যে। আর আমরাও পেয়ে গেলাম আর্য অভিবাসনের "অকাট্য" প্রত্ন নিদর্শন!
আমাদের শেখানো হয়েছে ২০০০/১৮০০ খ্রিষ্টপূর্বের আগের ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো ঘোড়াই ঘোড়া নয়, সরস্বতী নদী সরস্বতী নদী নয়, অগ্নীবেদি অগ্নীবেদি নয়, spoked wheel spoked wheel নয়, ঋগ্বেদের ভূগোল পরিষ্কারভাবে ভারত উপমহাদেশীয় হলেও তার প্রত্নতাত্ত্বিক সাযুজ্য খুঁজতে হবে মধ্যএশিয়ায় ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। যে কুরগান সংস্কৃতি অথবা ইয়াম্নায়া সংস্কৃতি বা অ্যান্ড্রোনোভো সংস্কৃতির একমাত্র পরিচয় তাদের প্রত্নতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসমূহ, তার ছিটেফোঁটাও ভারতীয় উপমহাদেশে আবিষ্কৃত না হলেও আমরা মেনে নিয়েছি যে সেই মানুষগুলোই নাকি ছোট ছোট দলে ঢুকে কম করেও পাঁচ হাজার বছর ধরে অন্তত ৪০ লক্ষ বা তার বেশি লোকের ব্যবহৃত, প্রচলিত ও সুদৃঢ় ভাবে প্রোথিত ভাষা, সংস্কৃতি মাত্র কয়েকশো বছরে একেবারে আমূল বদলে দিল!! অথচ যার কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ কোথাও নেই! তাহলে গান্ধার সমাধি সংস্কৃতি, সিমেটারি এইচ, ঝুকার, চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র সংস্কৃতি ইত্যাদির কথা যে বলা হলো, সেটা? আসলে ফেসবুকের সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেটা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা সম্ভব নয়। একটু অপেক্ষা করুন, বিস্তৃত আলোচনা আসবে। সম্ভবত পূর্ণাঙ্গ বই আকারেই। শুধু এটুকু বলে রাখি যে, এই বিষয়ের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতই এক্ষেত্রেও খুব সুচতুরভাবে আপনাদের ভক্তির প্রাবল্যকেই কাজে লাগানো হয়েছে, আর কিছু নয়।
আমি প্রত্নতত্ত্বের কথাই বলছি তার কারণ প্রত্নতত্ত্ব ইতিহাস নির্মাণের এমন এক হাতিয়ার যাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানসম্মতভাবে তারিখ নির্ণয়ে বা কোনো ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করতে এর জুড়ি মেলা ভার। প্রত্নতত্ত্ব স্বীকৃত নয় বলেই ঋগ্বেদ বা বৈদিক সাহিত্যের জ্যোতিষিক কালবিচার আমরা যেমন নির্বিচারে মানতে পারি না তেমনি ভাষাতত্ত্বের ধরে নেওয়া সময়ও আমরা মেনে নিতে পারি না যদি না সেটা প্রত্নতত্ত্ব স্বীকৃত হয়। কারণ যেকোনো প্রাচীন সংস্কৃতি ও তার কালের অকাট্য প্রমাণ একমাত্র প্রত্নতত্ত্বই দিতে পারে। তাহলে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সাহিত্যিক বিষয়বস্তুর কি কোনো গুরুত্ব নেই? অবশ্যই আছে। বেদ, পুরান বা রামায়ণ, মহাভারতে ইতিহাসের উপাদান নিশ্চয়ই আছে কিন্তু তার গোটাটাকেই ইতিহাস ভেবে ফেললে সেটা অন্ধবিশ্বাস মাত্র। অপরদিকে প্রত্নতত্ত্বের প্রতিটি অনু পরমানুই স্বয়ং ইতিহাস। তাই প্রাক ও প্রায় ইতিহাস পর্বের যেকোনো তত্ত্ব যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রত্নতত্ত্বের সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত হচ্ছে ততক্ষণ তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। সেই তত্ত্ব আঁকড়ে পড়ে থাকা, স্রেফ কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়।
তবু কিছু মানুষ চিরকালই কুসংস্কার আঁকড়ে বাঁচতে চান। হরপ্পা সভ্যতার শেষ পর্যায়ে সেখানকার লোকেরা পূর্ব দিকে সরে আসে, এই সহজ সত্য অনেকের কাছেই মেনে নেওয়া অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে, তার রাশি রাশি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও। উল্টোদিকে তাদের দক্ষিণের গভীরে বা তথাকথিত আধুনিক দ্রাবিড়ভূমিতে বসতি স্থাপনের কোনো প্রমাণ এখনো পর্যন্ত নেই। মহারাষ্ট্রের দাইমাবাদ হরপ্পা সভ্যতার শেষ পর্বের দক্ষিণতম কেন্দ্র। তার দক্ষিণে হরপ্পা সভ্যতার কোনো কেন্দ্র পাওয়া যায়নি। কিন্তু তার বিন্দু বিসর্গও সেখানে খুঁজে পাওয়ার জন্য কিছু মানুষের মরিয়া চেষ্টা দেখে সত্যিই অবাক হতে হয়। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই।
একেবারে শেষ ছবি দুটি লক্ষ করুন। এই নব্যপ্রস্তরযুগীয় পাথরের কুঠার জাতীয় বস্তুটি ২০০৬ সালে তামিলনাড়ুর সেম্বিয়ান কান্দিয়ুর গ্রাম থেকে পাওয়া গেছে (Mahadevan, 2009, pp. 13-14)। সময়কাল ধারণা করা হয়েছে মোটামুটিভাবে ২০০০ - ১০০০ খ্রিষ্টপূর্ব। এর মাঝখানে যে ছাল ওঠা মত অংশ রয়েছে সেগুলো নাকি আসলে হরপ্পীয় অক্ষর! এবং এর ভিত্তিতেই নাকি বোঝা গেছে যে দক্ষিণ ভারতের নব্যপ্রস্তরযুগীয় মানুষেরা হরপ্পার মানুষজনেদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত (Mahadevan, 2006, p. 176)!
সত্যিই আমাদের বোধ, বুদ্ধি, বিচারের দীনতা হতবাক করে দেয়। একদিকে আমরা পরিষ্কার যজ্ঞবেদী, পশুবলিদান, ঘোড়ার হাড়, মূর্তি, অর আঁকা চাকা, সরস্বতী নদী এমনকি কখনো আদ্যন্ত গোটা একটা হরপ্পা সভ্যতা কেন্দ্রকেই হরপ্পীয় বলে অস্বীকার করি, অন্যদিকে নব্যপ্রস্তর যুগের পাথরের কুঠারের ফলার ওপর খুদে যাওয়া হিজিবিজিকেও কেউ হরপ্পা অক্ষর বলে দাবি করে বসেন এবং আমরা চুপচাপ থাকি!
আমি ভাবি যে এই বস্তুটি দক্ষিণভারতের বদলে যদি পূর্বভারতের কোনো অঞ্চল থেকে পাওয়া যেত এবং তার ভিত্তিতে যদি কেউ দাবি করতেন যে হরপ্পার অধিবাসীরা শেষ পর্যায়ে পূর্বদিকে চলে এসেছিল তাহলে আমাদের "EMINENT HISTORIAN" এর দল তাঁকে ঠিক কী কী অভিধায় ভূষিত করতেন!
আসলে খুব ছোট থেকেই আমাদের মনে এবিষয়ে একটা ধারণা খুব সুচারুভাবে বুনে দেওয়া হয়েছে। হরপ্পা সভ্যতা - তার পতন - আর্যদের আগমন - একটা অন্ধকার যুগ - তারপর আবার গঙ্গার তীরে জঙ্গল সাফ ও নগরায়ন। আমাদের বোঝানো হয়েছে হরপ্পা সভ্যতা মানেই নগর, নগর আর নগর। আর এই ধারণা এতটাই বদ্ধমূল যে আজকের প্রথিতযশা ঐতিহাসিকও তাঁর প্রায় বেস্টসেলার পর্যায়ের বইতে লেখেন, 'The Harappan civilization was undoubtedly the largest in extent among the Bronze Age civilizations. Most of the sites are urban in nature, consisting very large cities and smaller towns.' (Chakravarti, 2010, p. 20) অথচ পরের পাতাতেই তিনি লিখছেন, 'On this count he(Habib) estimates that in the third millennium BC, the rural population would have been more than fifteen times and therefore estimates the total population of the Harappan civilization at 4,000,000.' (Chakravarti, 2010, pp. 20-21) যদি হরপ্পা সভ্যতার বেশিরভাগ কেন্দ্রই শহুরে কেন্দ্র হয় তাহলে এই ১৫ গুন গ্রামীণ মানুষজন এলো কোত্থেকে? আসলে হরপ্পা সভ্যতাকে প্রাণপণে শহুরে প্রমাণ করার তাগিদে আমরা এটা প্রায়শই ভুলে যাই যে এই সভ্যতার নাগরিক কেন্দ্রের সংখ্যা হাতে গোনা। এমনকি উপরোক্ত ইতিহাসবিদের দেওয়া 'Reading List' এ শ্রী কেনোয়ারের যে বইটির নাম জ্বল জ্বল করছে তার ৪৯ পাতায় প্রত্নবিদের সুস্পষ্ট লেখাটিও তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়, 'Most of the 1500 settlements found in the Indus and Saraswati regions can be classified as small villages or hamlets (less than 1 and up to 10 hectares) with a few larger towns and small cities (10 to 50 hectares).' আসলে এই পর্বের ইতিহাস 'লিখতে' বসে অনেকের মনেই একটা প্রচ্ছন্ন আশঙ্কা কাজ করে। গ্রামের কথা-টথা বললে মানুষ যদি আর্য/বৈদিক ইত্যাদি ভেবে ফেলে! আর এর ফলেই তাঁদের মন্তব্যগুলো অনেকসময়েই পরস্পরবিরোধী, অসত্য, অর্ধসত্য ও বিকৃত হয়ে যায়। এটা সেইসমস্ত মন্তব্যের ভিড়ে নিতান্ত নগণ্য একটি উদাহরণ মাত্র।
আসলে সমস্যাটা আমাদের। আমরা পড়ি, কিন্তু প্রশ্ন যেটা করি সেটা আমাদের ওই গুরুমশাইদের শিখিয়ে দেওয়া। আর তার বদলে তাঁদের কাছে বাঁধা রাখি আমাদের স্বাধীন চিন্তা ভাবনার বিচরণভূমিটি। তাই তাঁদের কথাই আমাদের কাছে স্বতঃপ্রমাণ হয়ে উঠতে থাকে। আর তাঁরা হয়ে উঠতে থাকেন প্রশ্নাতীত। তাই তাঁরা নির্দ্বিধায় 'ইতিহাস রচনা' করে চলতে পারেন। আর আমাদের নাকের ডগায় মূলোর ঝুঁটির মত ঝুলতে থাকে গ্রাম-শহর, ঘোড়ার হাড়, গান্ধার সমাধি সংস্কৃতি, পি জি ডব্লিউ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
আসলে উপমহাদেশের যথার্থ প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে এসব কাল্পনিক আর্য অভিবাসনের কোনো স্থান নেই। তাই আর্যতত্ত্বের প্রবক্তা, পৃষ্ঠপোষক ও প্রচারকরা প্রত্নতত্ত্বের কথা উঠলেই হয় তৎক্ষণাৎ এড়িয়ে যান অথবা চালাকির দ্বারা সেটাকে অন্য পথে চালানোর চেষ্টা করেন নতুবা সরাসরি মিথ্যে কথা বলেন। মজার কথা হলো এই চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক মানসিকতার মানুষগুলোই বিজ্ঞানভিত্তিক ইতিহাসচর্চা হচ্ছে না বলে গলা চড়ান। ভাষাতত্ত্ব যেমন কোনো বিষয়ের বা ঘটনার absolute তারিখ নির্ণয় করতে পারে না তেমনই জিনবিদ্যা কোনো মানুষের মুখের ভাষা, তার সংস্কৃতির হদিশ দিতে অক্ষম (জিনবিদ্যার আধুনিকতম বহুল আলোচিত প্রবন্ধ দুটির বিচার ও পর্যালোচনা করার ক্ষমতা আমার নেই। যদিও দেখেছি যে যাঁরা এই বিষয় নিয়ে রীতিমত আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণ ও মতামত প্রদান করে চলেছেন তাঁদের সিংহভাগই প্রবন্ধ দুটি খুঁটিয়ে পড়েননি, কেবল লেখকদের সিদ্ধান্ত পড়েই সবটা আয়ত্ত করে ফেলেছেন! তবে সকলেই তো এমন প্রতিভার অধিকারী হন না, সেখানে উল্লেখ করা সমস্ত তথ্য বিচার, বিশ্লেষণ করেও অনেককে বুঝে নিতে হয়। এমন কয়েকজনের লেখার মধ্যে থেকে একটির লিংক এই লেখার শেষে দেওয়া থাকলো। প্রয়োজনে দেখে নিতে পারেন। তবে মোদ্দা কথাটা একই থাকে, জিনবিদ্যা কিন্তু মানুষের ভাষা বা সংস্কৃতির পরিচয় নির্ণয় করতে পারে না।) যদি কেউ সেটা দাবি করেন, সেটা বিজ্ঞান নয়, গা জোয়ারী মাত্র। তাই প্রাচীন মানুষের সংস্কৃতি, তার সময়কালের সঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক হিসাব যে প্রত্নতত্ত্ব দিতে পারে সেটাকে যথাসম্ভব পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মধ্যে আর যাই হোক বিজ্ঞানমনস্কতা নেই।
উল্টোদিকে যাঁরা এর বিপরীত মত পোষণ করেন ও সেই মত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পোস্টে ব্যক্ত করেন, সেখানেও বিজ্ঞানসম্মত মনোভাব প্রকাশ পায় না। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণের ঘটনাকে তাঁরা ইতিহাস ধরে নিয়ে নিজেদের খেয়াল খুশি মত ইতিহাস তৈরী করতে থাকেন, যেটা প্রত্নতত্ত্ব কেন, কোনো তত্ত্বই সমর্থিত নয়। এই যেমন কিছু পোস্টে দেখলাম দ্বারকা নগরীর বয়স কেউ কেউ ৭৫০০ বছর আবার কেউ কেউ ১০০০০/১১০০০ বছর বলে দাবি করছেন! এও দাবি করেছেন যে এই বয়স নাকি কার্বন ১৪ পরীক্ষা দ্বারা সমর্থিত! কেউ আবার সমুদ্রের তলায় দ্বারকা নগরীর প্রত্ন অবশেষের ছবিও দিয়েছেন! অথচ এর একটাও প্রত্নতত্ত্ব সমর্থিত নয়। দ্বারকা ও বেট দ্বারকা থেকে প্রাচীনতম যে থার্মোলুমিনিসেন্স তারিখ পাওয়া গেছে সেটা ১৫২৮ খ্রিষ্টপূর্ব (Rao, 1999, p.1, Figures and Plates) এবং কার্বন ১৪ পদ্ধতিতে নির্ণীত তারিখ মোটামুটিভাবে ১৮০০ থেকে ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব (Gaur and Sundaresh, 2005, p. 94)। এছাড়াও আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখেছি যে এঁরা যে দাবিগুলো করেন এবং যেভাবে রেফারেন্স দেন তা অনেকসময়েই ভুলে ভরা ও উল্টোপাল্টা। আসলে আমাদের অনেকের মনেই একটা ধারণা আছে যে পৃথিবীর যাবতীয় কিছুর সূচনাস্থল ভারতবর্ষ এবং সেই অবৈজ্ঞানিক ধারণার জন্যই আমরা আমাদের সমস্ত কিছু প্রাচীন বস্তুতেই এমন একটা প্রাচীনত্ব আরোপ করতে থাকি, যার সাথে আর যাই হোক বিজ্ঞানসম্মত প্রত্নতত্ত্বের কোনো সংযোগ নেই। প্রাচীন ইতিহাস চর্চায় প্রত্নতত্ত্বকে এড়িয়ে যাওয়া বা প্রত্নতত্ত্বের নামে যথেচ্ছাচার করা দুটোই সমান বিপজ্জনক।
যেটা সবথেকে বেশি প্রয়োজন সেটা হলো ভারতীয় উপমহাদেশের একটি সুনির্দিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস রচনা। পাথুরে প্রমাণহীন রসালো তত্ত্ব নয় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জোগাড় করা তথ্যেই রচিত হবে যথার্থ ইতিহাস। আর ঠিক এই কথাই শ্রী দিলীপ চক্রবর্তী আবারও মনে করিয়ে দিয়েছেন তাঁর সাম্প্রতিকতম বইতে, 'The fact that comparative philology cannot date anything independently ensures that it cannot have any place in historical studies which, after all, have to be based on sound chronology.'(Chakrabarti, 2021, pp. 319-320)।
তথ্যের সূত্র :
Chakrabarti, Dilip, K. 2021. 'Nationalism in the study of Ancient Indian History'. Aryan Books International, New Delhi.
Chakravarti, Ranabir. 2010. 'Exploring Early India : Upto c. AD 1300'. Macmillan Publishers India Limited, New Delhi.
Gaur, A. S. and Sundaresh. 2005. 'Late Harappan Copper Fishhook: Evidence on the Advance Fishing Technology in Ancient India' in 'Archaeology of Bet Dwarka Island'
(Edited by A. S. Gaur, Sundaresh and K. H. Vora). Aryan Books International, New Delhi. In association with National Institute of Oceanography, Goa.
Mahadevan, Iravatham, 2006. 'A Note On The Muruku Sign Of The Indus Script' in 'International Journal of Dravidian Linguistics' Vol. XXXV No. 2 June 2006.
Mahadevan, Iravatham, 2009. 'Vestiges of Indus Civilisation in Old Tamil'. Tamilnadu Endowment Lecture, Tamilnadu History Congress, 16th Annual Session, 9-11 October 2009, Tirucbirapalli, Tamilnadu.
Rao, S. R. 1999. 'The Lost City of Dvaraka'. Aditya Prakashan, New Delhi.

Post a Comment

Previous Post Next Post