তন্ত্র মতে ঈশ্বর উপাসনা কেবল বাংলার মাটিতেই হতো না, হতো সারা ভারত জুড়ে: কয়েকটি ঐতিহাসিক প্রমাণ
- স্বাগতা মন্ডল
তান্ত্রিক ধর্মচর্যা ও তার প্রাচীনত্ব ইত্যাদি সম্বন্ধে নির্দিষ্ট সাল তারিখ দিয়ে নিশ্চিত হওয়ার মতো কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য যদিও এখনও আমাদের হাতে নেই, তবু কিছু কিছু সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যে তান্ত্রিকতার প্রাচীনত্ব নির্দেশ করে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। সুখময় শাস্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী– ‘মেদিনী-কোষে দেখা যায়, তন্ত্র শব্দের অন্যতম অর্থ শ্রুতির শাখাবিশেষ। সাধারণতঃ তন্ত্রশব্দ শাস্ত্র-বাচক। বিশেষ অর্থে আগম-শাস্ত্র বা সাধন-শাস্ত্রকে বুঝায়। তন্ত্রশাস্ত্রের প্রাচীনতার অনুকূলে আরও একটি কথা বলিবার আছে। স্মৃতিসংহিতা এবং পুরাণাদিতে কোথাও স্পষ্টতঃ, কোথাও বা ভাবতঃ তন্ত্রশাস্ত্রের উল্লেখ আছে।’ (তন্ত্রপরিচয়, পৃষ্ঠা-১৮)
বৃহৎসংহিতাকার (আনুমানিক খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক) বরাহমিহির অতি অল্প কথায় মাতৃকাদের মণ্ডলক্রমানুযায়ী ধর্মানুষ্ঠানের বিষয়ে বলেছেন। তার এক শতাব্দী পরে (সপ্তম শতকের প্রথমভাগে) ভারত পরিভ্রমণকারী চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তাঁর সি-ইউ-কি গ্রন্থে গান্ধার পরিক্রমার বিবরণ প্রসঙ্গে লিখেছেন যে–
‘প্রাচীন গান্ধার প্রদেশের (ভারত সম্বন্ধীয় বৈদেশিক লেখকগণের মতানুযায়ী এটি বর্তমান পশ্চিম পাকিস্তানের পেশোয়ার জেলার প্রাচীনকালে প্রচলিত নাম) মধ্যস্থলে ভীমাদেবী পর্বত নামে একটি বৃহৎ পর্বতশৃঙ্গ ছিল। তার উপরে মহেশ্বরের পত্নী ভীমাদেবীর গাঢ় নীলবর্ণের প্রস্তরের এক প্রতিকৃতি ছিল। স্থানীয় জনগণের মতে দেবীর প্রতিকৃতিটি অকৃত্রিম এবং তাঁর মন্দির ভারতের সকল অংশের দেবীপূজকদের পবিত্র গন্তব্য বা দ্রষ্টব্য স্থান ছিল। পর্বতের সানুদেশে মহেশ্বরদেবের এক মন্দির ছিল; এখানে ভস্মলিপ্ত তীর্থিকগণ (এরা পাশুপত সম্প্রদায়ভুক্ত বলে ধারণা করা হয়) বিশেষ পূজা করতেন।’ (সূত্র: পঞ্চোপাসনা)
[There was a great mountain-peak in the heart of ancient Gandhara (modern Peshwar district), which possessed a likeness or image of Mahesvara’s spouse Bhimadevi of dark blue stone. According to local accounts, this was a natural image of the goddess; it was a great resort of devotees from all parts of India. At the foot of the mountain was a temple to Mahesvara-deva in which the ashsmearing Tirthikas performed much worship.’- Watters, On Yuan Chwang, Vol. 1, pp. 221-22]
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, এই চৈনিক পরিব্রাজক তাঁর নিজস্ব ভঙ্গীতে আমাদেরকে ভৈরবস্থান সংবলিত একটি প্রাচীন শাক্তপীঠ সম্বন্ধে অতি মূল্যবান তথ্য প্রদান করেছেন। উল্লেখ্য, শাক্তপীঠ হলো বস্তুত তান্ত্রিক-সাধনপীঠ। পরবর্তীকালে যেগুলো বিভিন্ন পৌরাণিক কল্পব্যাখ্যায় পল্লবিত হয়ে শক্তিপীঠ বা দেবীপীঠ নামে প্রচারিত হয়। অতএব, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে গান্ধার প্রদেশস্থ একটি শাক্তপীঠ ভারতবিখ্যাত থাকলে পীঠপূজার প্রবর্তন যে তারও বহু পূর্বে হয়েছিল, এ অনুমান অসঙ্গত হবে না নিশ্চয়ই।
এবিষয়ে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও যে বিভিন্ন গবেষকরা প্রাপ্ত হয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এইসব প্রত্নতত্ত্বগত প্রমাণ থেকে তান্ত্রিক শক্তি-উপাসকের ধর্মানুষ্ঠান বিষয়ে কিছু আকর্ষণীয় তথ্য আমরা জানতে পারি। যেমন গুপ্তযুগ ও তার অব্যবহিত পরবর্তীকালের কিছু শিলালিপির কথা জানা যায়। এ বিষয়ে পঞ্চোপাসনা গ্রন্থের কিছু বিবৃতি গ্রন্থকার জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়ানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে–
‘মালব-বিক্রমাব্দ গত ৪৮১ (খৃষ্টীয় ৪২৩-২৪) বৎসরের একটি শিলালেখ মধ্য-ভারতের ঝালরাপাটন সহরের ৫২ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত গাঙ্গধার নামক গ্রামে পাওয়া গিয়াছিল। ইহা হইতে আমরা জানিতে পারি যে প্রথম কুমারগুপ্তের সামন্তরাজ বন্ধুবর্মনপুত্র বিশ্ববর্মনের ময়ূরাক্ষক নামক জনৈক মন্ত্রী একই সময়ে একটি বিষ্ণুমন্দির এবং মাতৃকাদিগের একটি মন্দির নির্মাণ করাইয়াছিলেন। তান্ত্রিক শক্তি-উপাসনার ধর্মাচরণ সম্পর্কিত যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই সুপ্রাচীন লেখ হইতে সংগ্রহ করা যায়…কিন্তু এখানে লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে ময়ূরাক্ষক যদিও ভাগবত ছিলেন এবং বিষ্ণুর মন্দির নির্মাণ করাইয়াছিলেন (বিষ্ণোঃ স্থানমকারয়ৎ ভাগবতস্-শ্রীমান-ময়ূরাক্ষকঃ) তথাপি তিনি পুণ্যার্জনের জন্য তান্ত্রিক শক্তি-উপাসকগণের দ্বারা পূজিত মাতৃকাদিগের মন্দির নির্মাণ করাইতেও পরাঙ্মুখ হন নাই। একই সঙ্গে বিষ্ণু ও মাতৃকা মন্দির জনৈক বিষ্ণুভক্তের (ভাগবতের) দ্বারা নির্মাণ করানো এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। মাতৃকাদিগের মধ্যে বৈষ্ণবী ও বারাহী বিষ্ণুর সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বিহার প্রদেশস্থ বিহার নামক সহরে প্রাপ্ত একটি প্রস্তরস্তম্ভের গাত্রে উৎকীর্ণ প্রথম কুমারগুপ্ত ও তাঁহার পুত্র স্কন্দগুপ্তের সমকালীন এক অর্ধভগ্ন লেখ হইতে জানা যায় যে যূপ বলিয়া বর্ণিত স্তম্ভটি কতকগুলি মন্দিরের সম্মুখে উচ্ছ্রিত হইয়াছিল; মন্দিরগুলির মধ্যে দেবী ভদ্রার্যা, মাতৃকাগণ এবং স্কন্দ কার্তিকেয়ের মন্দির ছিল। দেবীর ভদ্রার্যা নামটি লক্ষণীয়; ভদ্রকালীর বা সুভদ্রার ভদ্রা এবং আর্যাস্তবের আর্যা একত্রিত হইয়া ইহার উৎপত্তি হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। গয়া জিলার বরাবর গুহাগুলির সন্নিকট নাগার্জুনি পর্বতগুহাস্থ একটি শিলালেখ আমাদিগকে জানাইয়া দেয় যে মৌখরিরাজ অনন্তবর্মন এই গুহামন্দিরে কাত্যায়নী দেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। লেখে দেবীর যে বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে তাহা হইতে জানা যায় যে ইহা ছিল মহিষমর্দিনীর মূর্তি; দেবীকে ভবানী বা ভবের (শিবের) পত্নীও বলা হইয়াছে।’
এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা আবশ্যক যে, দেবীপূজার এক পর্যায় যে প্রথমত ও প্রধানত বিষ্ণু শিবাদি দেবতাকে আশ্রয় করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। মৌখরিরাজ অনন্তবর্মন কর্তৃক নাগার্জুনি পর্বতে শক্তিমন্দিরে যে কাত্যায়নী দেবীর (মহিষাসুরমর্দিনী) বিগ্রহ স্থাপনের কথা বলা হয়েছে, সে প্রেক্ষিতে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আরো বলছেন–
‘অনন্তবর্মন হয়ত নিজে শক্তি-পূজক ছিলেন, এবং তাঁহার ইষ্টদেবীর প্রতিমা তাঁহার সাধনসৌকর্যার্থে গুহামন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। অবশ্য ইহা জোর করিয়া বলা যায় না, কারণ লেখটিতে তাঁহার নামের পূর্বে এমন কোনও বিশেষণ নাই যাহা তাঁহাকে শাক্ত সম্প্রদায়ভুক্ত বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়া দেয়। তবে খৃষ্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকের দুইটি বিখ্যাত রাজবংশ যে শক্তি-উপাসনার সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল, ইহা তত্তৎবংশীয় রাজগণের লেখমালা হইতে বুঝা যায়। এ রাজকুল দুটি দক্ষিণ ভারতের, একটি প্রাচীন কদম্বকুল ও অন্যটি প্রাচীন চালুক্যবংশ। কদম্বদিগের বহু লেখে নৃপতিগণ হারিতীপুত্র এবং স্বামি-মহাসেন ও মাতৃকাদিগের পূজক বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন (স্বামিমহাসেন-মাতৃগণানুধ্যাতানাং…হারিতীপুত্রাণাং)। প্রাচীন চালুক্যবংশীয় রাজগণ ‘হারিতীপুত্র সপ্তলোকের মাতা সপ্তমাতৃকাদিগের দ্বারা অভিবর্ধিত ও কার্তিকেয় দেবতার অনুগ্রহে সংরক্ষিত ও প্রাপ্তকল্যাণ’ বলিয়া তাঁহাদের লেখগুলিতে অভিহিত হইয়াছেন (হারিতীপুত্রানাং সপ্তলোকমাতৃভিঃ সপ্তমাতৃভিরভিবর্ধিতানাং কার্তিকেয়ানুগ্রহ পরিরক্ষণ প্রাপ্তকল্যাণ পরম্পরাণাং)। এজন্য Fleet যথার্থই বলিয়াছেন যে স্বামী মহাসেন (স্কন্দ কার্তিকেয়) ও সপ্তমাতৃকাগণ প্রাচীন কদম্ব ও প্রাচীন চালুক্য কুলের বাস্তুদেবতা বা ইষ্টদেবী স্বরূপ ছিলেন।…’
‘খৃষ্টীয় দশম শতকে উত্তর ভারতের কয়েকজন রাজা যে দীক্ষিত দেবী-উপাসক ছিলেন উহার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বর্তমান। কান্যকুব্জের গুর্জরপ্রতীহাররাজ বিনায়কপালের একটি লেখ হইতে জানা যায় যে যদিও তিনি নিজে সৌর ছিলেন (পরমাদিত্যভক্ত), তাঁহার অন্ততঃ তিনজন পূর্বপূরুষ শাক্ত ছিলেন। লেখটিতে তাঁহার পিতা মহারাজা শ্রীমহেন্দ্রপালদেব, পিতামহ মহারাজা শ্রীভোজদেব ও বৃদ্ধপ্রপিতামহ মহারাজা শ্রীনাগভট পরম ভগবতীভক্ত বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ইহা একই রাজবংশে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত রাজগণের অস্তিত্ব সপ্রমাণ করে। মহারাজা বিনায়কপাল ছিলেন পরমাদিত্যভক্ত বা সৌর এবং তাঁহার পিতা, পিতামহ ও বৃদ্ধপ্রপিতামহ ছিলেন পরমভগবতীভক্ত বা শাক্ত…, তাঁহার ভ্রাতা ও পূর্ববর্তী রাজা দ্বিতীয় ভোজদেব ও বংশের প্রথম রাজা দেবশক্তিদেব ছিলেন পরমবৈষ্ণব, এবং বংশের দ্বিতীয় নৃপতি বৎসরাজদেব ছিলেন পরমমাহেশ্বর (পাশুপত বা শৈব)। কিন্তু লেখে উক্ত আটজন মহারাজার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক (তিনজন) শক্তি-উপাসক ছিলেন।’- (পঞ্চোপাসনা)
তবে ‘গাঙ্গধার শিলালিপি’ নামে পরিচিত খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের শিলালেখটিই মনে হয় এ বিষয়ে আমাদেরকে সর্বাপেক্ষা প্রাচীনতম ইঙ্গিত প্রদান করে বলে জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ধারণা ব্যক্ত করেন। কেননা–
‘তান্ত্রিক ধর্মাচরণ যে প্রথমে খুব উগ্র প্রকৃতির ছিল উহার উল্লেখ ইহাতে পাওয়া যায়। সামন্তরাজ বিশ্ববর্মনের সচিব ময়ূরাক্ষক মাতৃকাদিগের জন্য যে মন্দির নির্মাণ করাইয়াছিলেন, লেখটিতে উহাকে ‘অত্যুগ্র বেশ্ম’ বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। ‘ইহা ডাকিনী পরিপূর্ণ ছিল; ইহারা আনন্দে উচ্চ ও ভয়ঙ্কর কলরব করিত, এবং তাহাদের ধর্মসংক্রান্ত তান্ত্রিক আচারাদি হইতে উত্থিত প্রবল বায়ু যেন সমুদ্রগণকে আলোড়িত করিত’ (মাতৃণাঞ্চ প্রমুদিতঘনাত্যর্থ-নির্হ্রাদিনীনাং তন্ত্রোদ্ভূত প্রবল-পবনোদ্বর্তিতাম্ভোনিধীনাং…গতমিদং ডাকিনী-সম্প্রকীর্ণাং বেশ্মত্যুগ্রং নৃপতিসচিবোহকারয়ৎ পুণ্যহেতোঃ)। পরবর্তী কালের বহু তান্ত্রিক গ্রন্থে ডাকিনী, লাকিনী, শাকিনী, যোগিনী প্রভৃতির কথা আছে। ইহারা তান্ত্রিক দেবীদিগের অনুচর বলিয়া কীর্তিত। কোষগ্রন্থে ডাকিনী কালীগণবিশেষঃ বলিয়া ব্যাখ্যাত হইয়াছে। গাঙ্গধার লেখের লিপিকার ডাকিনীদিগের কথা বলিয়া এবং উগ্র তান্ত্রিক আচারের উল্লেখ করিয়া সুস্পষ্টভাবেই ইহার অতিমার্গিকতা সম্বন্ধে নির্দেশ দিয়াছেন। প্রসঙ্গতঃ বলা যাইতে পারে যে এই লেখটিতেই মনে হয় আমরা তন্ত্র কথাটি এইরূপ অর্থে সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হইতে দেখি।’
(বৃহৎসংহিতাকার বরাহমিহিরও যে অতি অল্প কথায় মাতৃকাগণের মণ্ডলক্রমানুযায়ী ধর্মানুষ্ঠানের বিষয় বলেছিলেন তা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।) ‘আদি-মধ্যযুগে মধ্য ভারতে ও উড়িষ্যায় মণ্ডলাকারে চতুঃষষ্টি যোগিনীগণের মন্দির তান্ত্রিক পূজার জন্য নির্মিত হইত; ইহা জব্বলপুরের নিকট নর্মদা-তীরবর্তী ভেড়াঘাট চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরগুলির ধ্বংসাবশেষ, খাজুরাহোর উক্ত নামের মন্দির এবং উড়িষ্যাস্থিত হীরাপুর ও রাণীপুর ঝরিয়ালের চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরসমূহ হইতে জানা যায়। আদি-মধ্যযুগীয় তান্ত্রিক পূজার ভীষণতার কিঞ্চিৎ পরিচয় ভুবনেশ্বরস্থ বৈতাল দেউল মন্দিরের গর্ভগৃহে যে সব মূর্তি উৎকীর্ণ আছে উহা হইতেও পাওয়া যায়। ইহার গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত মূল বিগ্রহ শবাসনা নির্মাংসা কৃশোদরী চামুণ্ডাদেবী দর্শকের মনে যুগপৎ ভয় ও বিস্ময়ের উদ্রেক করে। মূর্তিটি সত্যই ভীতিপ্রদ, এবং ইহা যে তান্ত্রিক সাধকের একাত্মিকা ভক্তির আধার ছিল ইহাতে বিস্মিত হইতে হয়। মূল বিগ্রহের দুই পার্শ্বের প্রাচীরগাত্রে মাতৃকাগণের ও বীরভদ্র গণেশাদির মূর্তির সহিত আরও কয়েকটি মূর্তি খোদিত আছে। ইহাদের প্রত্যেকটির পরিচয় জানা নাই, তবে ইহাদের মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর পুরুষ মূর্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শ্মশ্রুমণ্ডিত জটিল অস্থিসার উর্ধ্বলিঙ্গ দ্বিভুজ পুরুষ মৃতদেহের উপর যোগাসনে উপবিষ্ট; ইহার এক পার্শ্বে ছিন্নশির মনুষ্যদেহ এবং অন্য পার্শ্বে একটি শিবা নরমুণ্ডচর্বণে রত। ইহা কোনও দেবতার মূর্তি বা অত্যুগ্র প্রকৃতির যোগসাধনায় রত সিদ্ধবিদ্যাপ্রয়াসী ঘোর তান্ত্রিক সাধকের মূর্তি, ইহা সঠিক বলা যায় না। বৈতাল দেউলের গর্ভগৃহ এত অন্ধকারপূর্ণ যে সাধারণ দর্শকের চক্ষে এইসব ভীষণ দৃশ্য পড়ে না। ভুবনেশ্বরের অনতিদূরে (৩/৪ মাইল) অবস্থিত হীরাপুর চৌষট্টি যোগিনীর ক্ষুদ্র মন্দিরের প্রবেশপথের প্রাচীরগাত্রে দুইটি ধাবনশীল, শ্মশ্রু ও জটামণ্ডিত, কোটরগত অক্ষি, নির্মাংস, উর্ধ্বলিঙ্গ, খড়্গহস্ত নরমূর্তি খোদিত আছে; ইহার পশ্চাতে অস্থিচর্বণশীল কুকুর বা শিবা ধাবমান। আমার মনে হয় এই মূর্তি দুইটি উগ্র তান্ত্রিক সাধকের, এবং বৈতাল দেউলের পূর্বোক্ত ঘোর মূর্তিটিও এই পর্যায়ের। হীরাপুরের যোগিনী মন্দির ছাদবিহীন দুইটি এককেন্দ্রিক ক্ষুদ্র ও নাতিবৃহৎ বৃত্তাকার মন্দির, এবং বৃত্ত দুটির ভিতরগাত্রে বিভিন্ন যোগিনীর ও মাতৃকাদিগের মূর্তি খোদিত। বৃহত্তর বৃত্তের বাহিরের প্রাচীরগাত্রে নয়টি দেবীমূর্তি দেখা যায়; প্রত্যেক মূর্তি সুরূপা যুবতী কন্যার কর্তিত শিরের উপর দণ্ডায়মান। দেবীদিগের সঠিক পরিচয় কি জানা নাই, তবে স্থানীয় লোকেরা ইহাদিগকে নব কাত্যায়নী বলিয়া থাকেন। ইহাদের প্রকৃত পরিচয় যাহাই হউক না কেন, এই আদি-মধ্যযুগীয় শক্তিমন্দির বৈতাল দেউলের ন্যায় তৎকালীন তান্ত্রিক শক্তি-উপাসকগণের উগ্র ধর্মচর্যা সম্বন্ধে বিশিষ্ট সাক্ষ্য প্রদান করে। গাঙ্গধার শিলালিপিতে মাতৃকাদিগের মন্দির যে কি কারণে ‘অত্যুগ্র বেশ্ম’ বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে উহা উড়িষ্যার উপরিলিখিত দুইটি মন্দিরসংস্থা হইতে বুঝা যায়।’- (পঞ্চোপাসনা)
পুরাণসমূহে যোগিনীদের কথা বিশেষভাবে উল্লিখিত হয়েছে, যাঁদের সংখ্যা চৌষট্টি। অগ্নিপুরাণে (১/১৪৬) বলা হয়েছে মাতৃকা আটজন এবং প্রত্যেকেরই আবার আট রকম করে প্রকাশ, যার ফলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় আটের আটগুণ। মধ্যযুগে চৌষট্টি যোগিনীর পূজো যে খুবই জনপ্রিয় ছিল, উপরিউক্ত জব্বলপুরের নিকটে ভেরাঘাট, খাজুরাহো, ভুবনেশ্বরের নিকট হীরাপুর, সম্বলপুরের নিকট রাণীপুর, করিয়াল প্রভৃতি স্থানের চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরসমূহই তার প্রমাণ।
Post a Comment